২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এরশাদ সাহেব নিঃসঙ্গ কেন? ডা. মিলনদের কান্না শুনতে পান না?

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। - ছবি: সংগৃহীত

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেব নাকি নিঃসঙ্গতা অনুভব করছেন? আর এজন্য হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন। আহারে!

এরশাদ সাহেব কেন আপনি নিঃসঙ্গ? কোন দিন কি সেই প্রশ্ন করেছেন নিজেকে? আপনার আশে-পাশের চাটুকাররা কোথায়? আপনার স্ত্রী রওশন এরশাদ কোথায়? আপনার পালিত কন্যা ও সন্তানরা কোথায়? আপনার এত এত আত্মীয় স্বজন তারা কোথায়?

২০১৪ সালে নির্বাচনের ঠিক আগ ‍মুহুর্তে (৩ ডিসেম্বর) এরশাদ ঠিক একই নাটক মঞ্চস্থ করেন। অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন। অবশ্য সরকার নাকি তাকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করান। তবে তাকে সে সময় গলফ খেলতেও দেখা গেছে। সেবার (দশম সংসদ নির্বাচনে) আওয়ামী লীগ ওয়াক ওভার পেয়ে ক্ষমতায় আসে।

আবারো ঠিক পাঁচ বছর পর সেই ডিসেম্বর মাসেই (৪ ডিসেম্বর) এরশাদ অসুস্থ হন। এবার প্রথাগত অসুস্থ নন। এরশাদ নাকি নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। নিঃসঙ্গতায় ভোগারই কথা। ৮৯ বছর বয়সে তার পাশে থাকার কথা স্ত্রী-সন্তান, নাতি-নাতনী ও আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু এই বয়সেও তিনি আবারো বঙ্গভবনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তার খায়েশ হলো একদিনের জন্য হলেও তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হবেন। আর এজন্য তিনি হেন কোন আকাম নাই যে করেন নাই। মনোনয়ন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাই করেছেন। আর বলির পাঠা বানিয়েছেন মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদারকে।

নির্বাচনের আগে যে কোন সময় এরশাদ ডিগবাজি দিতে পারেন বলে রাজনীতির মাঠে গুঞ্জন আছে। আর তাই সরকার এরশাদকে কোন রকম রিস্ক নিতে চাইছেন না। ফলে এত এত..নাটক।

এরশাদ সাহেব নিঃসঙ্গ কেন? নূর হোসেন তো আপনার আশে-পাশেই অবস্থান করছে। ডা. মিলন সে তো পিজি হাসপাতাল ছেড়ে সিএমএইচে আপনার সুসজ্জিত বিছানার আপনার পাশেই আছে। রাউফুন বসুনিয়া ওপার থেকে আপনাকে স্বাগতম জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন এবং দীপালি সাহাসহ সবাই অধীর আগ্রহে আপনার জন্য ‍দিন গুনছে।

আপনারতো কোন সন্তান নেই। (এরিক নামে বিদিশার সংসারে একজন ছেলে সন্তান আছে)। আপনি তো আপনার কোন সন্তান হারাননি। তাহলে এত নিঃসঙ্গ কেন? ক্ষমতায় থাকাকালে আপনার অঙ্গুলিতে দেশ কাঁপত। সেনানিবাস থেকে সৈন্যরা বেড়িয়ে আসত। তারপর আপনি যা হুকুম দিতেই তারা তাই করত।

চিন্তা করুন তো নূর হোসেনের মা কেমন নিঃসঙ্গ অনুভব করছে। ডা. মিলনের বৃদ্ধা মা এখনো বিচারের আশায় বেঁচে আছেন। তিনি তার সন্তান হারিয়ে কেমন নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন একবার ভাবুন তো। কই কখনো তো শুনিনি তারা নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আজ ৬ ডিসেম্বর। গণতন্ত্র মুক্তি দিবস। স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় নিতে হয়।

সেই ডিসেম্বর মাসেই প্রতাপশালী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নাকি নিঃসঙ্গতা কাটাতে হাসপাতালে ভর্তি হন। জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা এমনটাই জানিয়েছেন। এদিকে নিঃসঙ্গতা কাটাতে হাসপাতালে ভর্তির আগে দলের মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদারকে তার স্বপদ থেকে সরিয়ে দেন। আর নতুন মহাসচিব করেন সরকারের আস্থাভাজন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে।

জাপার মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা দলীয় প্রধান এরশাদের অবস্থা সম্পর্কে বলেন, তিনি শতভাগ সুস্থ আছেন। তিনি নিঃসঙ্গ তাই আজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন। এরপর থেকেই এরশাদের হটকারিতা শুরু।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলনে শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন এবং দীপালি সাহাসহ আরো নাম না জানা অনেকে। শিক্ষার্থীদের মিছিলের মধ্যে ট্রাক উঠিয়ে দেয়ার মতো নৃশংসতাও শুরু করেন এরশাদ।

১০ নভেম্বর গুলিস্তানে বর্তমান জিপিও এর সামনে নূর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে এরশাদের পেটোয়া বাহিনী। তার বুকে পিঠে লেখা ছিল, স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। জাতির দুর্ভাগ্য দুটোর কোনটাই পূরণ হয়নি। নূর হোসেন হয়তো আমাদের অভিশাপ দিচ্ছেন।

১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এরশাদ সে সময় ছাত্র আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করানোর জন্য একটি চক্রকে ব্যবহার করে। পুলিশের ছত্রছায়ায় এই চক্রের গুলিতে ২৭ নভেম্বর টিএসসির সামনে তৎকালীন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন শহীদ হন। ডা. মিলনের তাজা রক্ত ছাত্র-গণআন্দোলনকে আরও বেগবান করে। সেদিন থেকে সাংবাদিকরা সব সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট আহ্বান করেন।

এরপর সপ্তাহ খানেক পর ৫ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা করেন। সেদিনই রাজপথে জনতার ঢল নামে। আন্দোলনরত দল ও জোটগুলোর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে প্রথম নির্দলীয় নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ থেকে স্বৈরতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক বিদায় ঘণ্টা বাজে এবং শুরু হয় গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা।

কিন্তু এরশাদ এরপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছেন। আঞ্চলিক রাজনীতিসহ জাতীয় রাজনীতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন।

২০০৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ডিসেম্বর মাসেই এরশাদ অনেক নাটক করেছিলেন। ফলে সে নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসেন ফখরুদ্দিন-মইন সরকার। অনেক ঘটনার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগ সরকার।

আবার ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে এরশাদ নাটক মঞ্চস্থ করেন। সিএমএইচে ভর্তি হন।

পাঁচ বছর পর সেই ডিসেম্বর মাসেই (৪ ডিসেম্বর) এরশাদ আবারো অসুস্থ হন। এবার প্রথাগত অসুস্থ নন। এরশাদ নাকি নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। ভয় পাবেন না ডা. মিলন সিএমএইচে আপনার পাশেই আছেন। প্রতিরাতে আপনাকে দেখতে আসবেন। আশে-পাশে ভালো করে তাকান দেখবেন নূর হোসেন, জয়নাল, দিপালী, বসুনিয়াদের।

 

আবুল হাসান, ঢাকা। ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস উপলক্ষে লিখিত। (লেখকের নিজস্ব অভিমত, লেখকই এরজন্য দায়ী।


আরো সংবাদ



premium cement